X-লিংকড ডিজঅর্ডার বা X ক্রোমোজমের ত্রুটিজনিত রোগের মধ্যে বিরল এক প্রকার বংশগতি রোগ হলো উইস্কট-অল্ড্রিচ সিনড্রোম (Wiscott-Adrich Syndrome)। ড. আলফ্রেড উইস্কট এবং ড. রবার্ট অলড্রিচ নামক দুজন এ আবিষ্কারকের নামেই রোগটি নামকরণ করা হয়। ১৯৩৭ সালে জার্মান শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ড.আলফ্রেড উইস্কট প্রথম এ রোগটি শনাক্ত করেন। তিনি একই পরিবারের তিন ভাইয়ের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ সমূহ দেখতে পান। সেই তিন ভাই এর প্রত্যেকেই অনেক অল্প বয়সে রক্তক্ষরণ ও বিভিন্ন সংক্রমণ ঘটে মারা যায়। উল্লেখ্য যে, তাদের বোনদের ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। প্রায় ১৭ বছর পর, আরেক আমেরিকান শিশু বিশেষজ্ঞ, ড. রবার্ট অল্ড্রিচ একটি ডাচ পরিবারের ছেলের ক্ষেত্রেও একই লক্ষণ দেখতে পেয়ে তার পূর্ববর্তী ছয় জেনারেশন পর্যালোচনা করেন এবং ড. উইস্কট এর তথ্যানুসারে মিলিয়ে দেখেন এটি একটি বংশগতি রোগ যা এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনে X-লিংকড রিসেসিভ পন্থায় বাহিত হয়। তাই নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মানবদেহে X ক্রোমোজমের রিসেসিভ ত্রুটির কারণেই এই রোগ ঘটে থাকে। অন্যদিকে, X ক্রোমোজম মানুষের দেহের ইমিউন সিস্টেমের প্রতি উচ্চ সংবেদনশীল। এজন্য এ রোগ ব্যাঘাত ঘটাতে পারে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায়ও।
সাধারণত রক্ত গঠনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে যেসব কোষ সরাসরি দায়ী, তাদের কার্যক্ষমতা কমতে থাকে বিধায় তিনটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে এ রোগ প্রকাশ পায়। বৈশিষ্ট্যসমূহ হলো-
১. একজিমা: একজিমা এ ধরণের রোগীদের জন্য একটি অন্যতম উপসর্গ। সাধারণত শিশুদের মুখমন্ডল, কপাল কিংবা মাথার তালুতে এমনকি পুরো শরীরে চামড়ার নিচে লাল ছোপ ছোপজাতীয় দাগ দেখা দেয়। অনেক সময় মশার কামড়ের মত দাগ পরিলক্ষিত হয়।
২. প্লাটিলেট বা অনুচক্রিকা হ্রাস: রক্তের অনুচক্রিকা সংখ্যায় হ্রাস পাওয়া কিংবা আকারে সংকুচিত হয়ে যাওয়া এ রোগের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। যার ফলে, রক্ত জমাট বাঁধতে পারেনা এবং খুব সহজেই রক্তক্ষরণ ঘটে থাকে। এ অবস্থাকে সাধারণত “থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া” বলা হয়ে থাকে।
৩. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস: উইস্কট-অলড্রিচ সিনড্রোম রোগটির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, এটি রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়। স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়াশীল এন্ডিবডির অযথাযথ উৎপাদন লোহিত রক্ত কণিকা ও অনুচক্রিকার ধ্বংস ঘটায় যা ইমিউন সিস্টেমের একটি বড় প্রাদুর্ভাব হিসেবে বিবেচিত। ফলে ক্রমশই কমতে থাকে দেহের বাইরের শত্রুর আক্রমণকে প্রতিহত করার ক্ষমতা। ফলে, এনিমিয়া হতে শুরু করে,রক্ত নালিকার প্রদাহ, হার্ট, ব্রেইন, কিডনি, মাংসপেশি সহ বিভিন্ন অঙ্গের নানা সমস্যা দেখা দেয়।
এই ত্রয়ী লক্ষণের জন্য একে এক নামে “একজিমা-থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া-ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম” ও বলা হয়ে থাকে।
কারণ:
বোন ম্যারো সেল বা হেমাটোপোয়েটিক সেল থেকে রক্ত কোষ তৈরি হয় যাতে WASP নামক এক ধরণের প্রোটিন থাকে। সাধারণত WAS নামক জিন WASP তৈরির যাবতীয় নির্দেশ দিয়ে থাকে। এই WAS জিনের মিউটেশন এর কারণে WASP প্রোটিনের কার্রযকারিতা কমতে থাকে যা-ই মূলত উইস্কট-অল্ডরিচ সিনড্রোম নামক এই রোগটি ঘটায়। সুষ্ঠু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য অপরিহার্য লিম্ফোসাইট, এন্টিবডির সুস্থ ও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নিশ্চিত এবং প্লাটিলেট তৈরির জন্য উক্ত প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ প্রোটিনের ঘাটতি দেখা দিলেই প্রকাশ পায় উক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহ।
কাদের মধ্যে এ রোগ বেশি হয়?
উইস্কট-অল্ড্রিচ রোগটি শনাক্তের ইতিহাস থেকে দেখা যায়, নারীদের চেয়ে পুরুষদের দেহেই রোগটি বেশি দেখা যায়। এর কারণ হলো, X ক্রোমোজোমই WASP প্রোটিন তৈরি করে থাকে; যেহেতু পুরুষের দেহে একটি মাত্র X ক্রোমোজোম তাই নারীর চেয়ে পুরুষদেহে এই রোগটি বেশি হয়। বিরল এই রোগটি সাধারণত জনসংখ্যায় প্রতি ১০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ১-১০ জনের মধ্যে দেখা যায় অর্থাৎ আক্রান্ত ৯০% রোগীই পুরুষ।
লক্ষণ:
জন্মগত রোগ হওয়ায় জন্ম থেকে ৫ বছরের যেকোনো, সাধারণত জন্মের ১-২ বছরের মধ্যেই এ রোগের লক্ষণসমূহ প্রকাশ হতে পারে। যেসব লক্ষণ দেখা যায় তা হলো-
- নাক হতে, মুখ ও মাড়ি হতে ঘনঘন এবং দ্রুত রক্তক্ষরণ এমনকি মস্তিষ্ক থেকেও রক্তক্ষরণ;
- রক্তযুক্ত পাতলা পায়খানা;
- চামড়ার নিচে লাল লাল ছোপযুক্ত দাগ;
- ইনফেকশনজনিত বিভিন্ন সমস্যা (জন্মের তিন মাস পর দেখা যায়);
- একজিমা জনিত সমস্যা (জন্মের প্রথম ১ বছরের মধ্যে দেখা যায়);
- অটোইমিউনিটি (এনিমিয়া, আর্থ্রাইটিস,নেফ্রাইটিস, ভাসকিউলিটিস ইত্যাদি)।
রোগ নির্ণয়:
সাধারণত রক্ত ও ইমিউনোগ্লোবিউলিন লেভেল পরীক্ষা করে রোগটি শনাক্ত করা হয়। এলার্জি টেস্টিং (স্কিন ইমিউনোলজিক টেস্টিং) এমনকি লিউকেমিয়া পর্যায়ে যাওয়ার আশংকা থাকলে বোন ম্যারো বায়োপসি করেও পরীক্ষা করা হয়। তবে, বর্তমানে “ডিএনএ সিকোয়েন্স এনালাইসিস” এরকম জেনেটিক ডিজঅর্ডার ও সংশ্লিষ্ট সকল রোগ শনাক্তে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং চূড়ান্ত একটি পন্থা। এ রোগ পরীক্ষার ক্ষেত্রে নির্ধারিত আদর্শ নির্ণায়ক হলো-
- কম প্লাটিলেট (platelet) সংখ্যা (<৭০,০০০/মি.লি.) এবং আকারে ছোট প্লাটিলেট (প্লাটিলেট ঘনত্ব <৫ ফে.লি.)।
- IgG ও IgM এন্টিবডির পরিমাণ কম থাকে। অপরদিকে, IgA ও IgE এন্টিবডির পরিমাণ বেশি হয় (বয়স অনুসারে)।
- T-লিম্ফোসাইটের ক্রিয়া প্রায়শই অস্বাভাবিক থাকে।
- অটোইমিউন হিমোলাইটিক এনিমিয়া আছে কিনা তা জানার জন্য কুম্বস টেষ্ট করা হয়ে থাকে।
- রক্ত স্বল্পতা ও প্লেটিলেট হ্রাসের পিছনে অস্বাভাবিক এন্টিবডির উপস্থিতি আছে কিনা তা নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
- WASP প্রোটিনের ঘাটতি নির্ণয়ের জন্য কোষের ফ্লোসাইটোমেট্রি পরীক্ষা করা হয়ে থাকে।
চিকিৎসা:
উইস্কট-অল্ড্রিচ রোগের লক্ষণ প্রকাশ থেকে শুরু করে শনাক্তকরণের পর পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে এর বৈশিষ্ট্য কিংবা লক্ষণগুলোকে কেন্দ্র করেই চিকিৎসা করা হয়।
- রক্তক্ষরণের জন্য প্লাটিলেট অথবা লাল রক্ত ট্রান্সফিউশন করা হয়।
- প্রিডনিসোলন জাতীয় ষ্টেরয়েড ঔষধ প্রেসক্রাইব করা হয় যা অনেক সময় প্লাটিলেটের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, কিন্তু তা অল্প সময়ের জন্য।
- ইনফেকশন এর জন্য নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হয়।
- অবস্থা অনেক খারাপ হলে স্প্লিন কেটে ফেলা হয়, কিন্তু এতে ইনফেকশন এর মাত্রা বেড়ে যাবার ঝুঁকি থাকে। এক্ষেত্রে ইনফেকশন এর জন্য জীবনব্যাপী এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হয়।
এই পদ্ধতিগুলো অবলম্বন করে এ রোগের চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি সাধিত হলেও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনই এর এক মাত্র প্রতিকার মূলক চিকিৎসা। এতে প্রায় ৯০% রোগী আরোগ্য লাভ করলেও এতে করে বংশগতির ধারা ব্যাহত হয়না, রোগীর পরবর্তী প্রজন্মেও এ রোগ দেখা দিতে পারে।
আফরিদা তাবাসসুম
জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
তথ্যসূত্র: