একটি পাতা হল ভাস্কুলার উদ্ভিদ কান্ডের প্রধান পার্শ্বীয় সংযোজন যা সাধারণত মাটির ওপরে বহন করা হয় এবং সালোকসংশ্লেষণের জন্য বিশেষ হয়। পাতা এবং কান্ড একসাথে অঙ্কুর গঠন করে। পাতাগুলো সম্মিলিতভাবে “শরতের পাতায়” হিসাবে দেখা যায়।
আমরা কম বেশী সবাই জানি শীতের শুরুতে গাছের পাতা ঝরে যায়। কিন্তু অনেক সময় প্রশ্ন রয়ে যায় কেন গাছের পাতা ঝরে যায়। এই গাছের পাতা ঝরে যাওয়ার সাথে পানির অবদানও অপরিসীম।
সবুজ পাতায় রয়েছে ক্লোরোফিল। পাতায় গাছের খাবার তৈরি হয় এবং সেগুলো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ঋতু পাল্টানোর সাথে সাথে গাছের পাতাগুলো যেন রং পাল্টাতে শুরু করে সবুজ থেকে হলুদ বর্ণ এবং সর্বশেষ লালচে বর্ণের। বিবর্ণ পাতাগুলো এক সময় ঝরতে শুরু করে। এক পর্যায়ে নতুন পাতার আগমন দেখা যায়। এই মৌসুমকে বলা হয় “Fall”।
উদ্ভিদ বিদ্যায় গাছের পাতা ঝরার এই প্রক্রিয়া অ্যাবসিশন (Abscission) নামে পরিচিত। অ্যাবসিশন (Abscission) শব্দটি ল্যাটিন আব অর্থ “দূরে” এবং সিন্ডেয়ার অর্থ “কাটতে” থেকে এসেছে। প্রাণিবিদ্যায় অ্যাবসিশন হল দেহের কিছু অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে পড়া। যেমন একটি পাখি কুঁড়ি বা একটি শিকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মরক্ষার্থে ব্যবহৃত একটি লেজের অটোটমি।
কোষ জীববিজ্ঞানে অ্যাবসিশন বলতে সাইটোকাইনেসিস সমাপ্তির সময় দুটি কন্যা কোষের বিভাজনকে বোঝায়। উদ্ভিদের প্রজনন ও বীজ এবং ফলের ছড়িয়ে পড়া নিশ্চিতের জন্য অ্যাবসিশন গুরুত্বপূর্ণ। এটি দেহের অঙ্গগুলির ইচ্ছাকৃত ছায়াকে বুঝায়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকাশের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ে অনেক গাছপালা তাদের অঙ্গগুলির গোড়ায় দৃশ্যত। আলাদা আলাদা কোষগুলির এক বা একাধিক স্তর বিকাশ করে যেখানে পরিবেশগত এবং অন্তঃসত্ত্বা সংকেতের প্রতিক্রিয়া হিসাবে অ্যাবসিশন জোন (এজেড AZ) নামক একটি অঅস্থিভঙ্গ বা ফাটল ধরা প্লেনের সাথে একটি দূরত্ব সৃষ্টি হয়। উদ্ভিদের বিকাশ ঘটানোর প্রক্রিয়ায় অ্যাবসিশন নিয়ন্ত্রণে উদ্ভিদ হরমোন অক্সিন জড়িত। উচ্চ অক্সিন ঘনত্ব যদি এজেড কোষে পৌঁছায় তবে অ্যাবসিশন সক্রিয় হয় না। ইথিলিন এই প্রক্রিয়াটি প্ররোচিত করে।
আরবিডোপসিস ইথিলিন-সংবেদনশীল মিউট্যান্ট ET ১ এর উপর পুষ্পমাল্যতার গবেষণাগুলো প্রমাণ করে যে ইথিলিন রিসেপ্টারে একটি রূপান্তর বহন করে। যদি ET ১ এর গাছগুলিতে পুষ্পশূন্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে বিলম্বিত হয়েছিল। তবুও ফুলের অঙ্গগুলি অবশেষে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং অ্যাবসিশন সম্পর্কিত সমস্ত সেলুলার প্রক্রিয়াগুলি ঘটেছিল। এর থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে অন্যান্য অন্তঃসত্ত্বা সংকেতগুলি অ্যাবসিশন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদ্ভিদের মাঝে মাঝে বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন অংশকে ত্যাগ করতে হয়, যা আর প্রয়োজন নেই।
যেমন শরতের সময় একটি পাতা বা একটি ফুল ফোটানো নিষেধ বা প্রজননের প্রয়োজনে। বেশিরভাগ গাছপালায় শীতের আগে পাতাগুলি ঝরে যায়। অপ্রাপ্তির অপর এক রূপ হল ফলের ঝরা যখন কোনও গাছ অপরিপক্ক অবস্থায় ফলকে ছাড়িয়ে যায়। যাতে বাকি ফলগুলো পরিপক্কতা আনতে প্রয়োজনীয় সংস্থান সংরক্ষণ করতে পারে।
যদি কোনও পাতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে একটি গাছ গাছের সম্পূর্ণ ‘ব্যয়’ এর উপর নির্ভর করে জল বা সালোকসংশ্লেষণ দক্ষতা সংরক্ষণের জন্য এটিকে ছাড়িয়ে দিতে পারে। অ্যাবসিশন স্তরটি সবুজ-ধূসর বর্ণের। উদ্ভিদ প্রতিরক্ষার একটি উপায় হিসাবে অকাল পাতায়ও অ্যাবসেশন হতে পারে।
পিত্তিক এফিডস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় অকাল পাতাগত অবহেলা দেখা যায়। এফিড গলগুলির নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পাতাগুলি দ্বারা উদ্ভিদগুলি কীটসংখ্যার ব্যাপকহারে হ্রাস পেতে থাকে।
অ্যাবসেশনটি নির্বাচনী এবং গলের সংখ্যা বাড়ার সাথে পাতা ঝরে যাওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। গাছে যত বেশি পাতা থাকবে তত বেশি পানি হারিয়ে যাবে। ফলে পানি ঘাটতি দেখার সম্ভাবনা থাকে।
অন্যদিকে শীতকালে উদ্ভিদে কীটপতঙ্গের আক্রমণ বেড়ে যায়। এ আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে গাছ পাতা ঝরায়। পাতা ঝরানোর ফলে ক্যাভিটেশন কমে যায় যা উদ্ভিদের জাইলেম ভেসেলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। শীতকালের শুরুতে যখন দিনের দৈর্ঘ্য কমতে শুরু করে তখন তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতা দুটোই কমতে থাকে। এসময় উদ্ভিদের দেহের ও পাতার মধ্যকার অক্সিন উৎপাদনের তারতম্য দেখা দেয় যা পাতাগুলোকে ঝরে পড়তে সাহায্য করে। দিন ছোট হতে শুরু করলে কিছু কিছু উদ্ভিদ ক্লোরোফিল উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ঠিক তখনই পাতায় অন্যান্য রঞ্জক পদার্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শীতকালে দিন যখন আরও ছোট হয় তখন পাতার রং সবচেয়ে উজ্জ্বল দেখায়।
পাতায় বিদ্যমান অন্যান্য রঞ্জক পদার্থের মধ্যে রয়েছে ক্যারোটিনয়েড ও অ্যান্থোসায়ানিন। ক্যারোটিনয়েডের উপস্থিতিতে পাতা হলুদ, কমলা ও বাদামি বর্ণের দেখায়। পাতায় অ্যাবসিশন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর এরা উৎপাদিত হতে শুরু করে।
পাতা যেখানে গাছের সাথে সংযুক্ত থাকে অর্থাৎ পত্রবৃন্ত ও শাখার মধ্যবর্তী স্থানে এক ধরণের কোষ তৈরি হয়। এ কোষগুলোকে অ্যাবসিশন কোষ(Abscission cell) বা কর্তন কোষ বলা হয়ে থাকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এসব কোষ সংখ্যায় ও আকারে বাড়তে থাকে। বৃদ্ধিরত এই কোষগুলো আসতে আসতে পত্রবৃন্ত ও উদ্ভিদ দেহের মধ্যকার বিভিন্ন কোষের স্তর ভেঙ্গে দেয় যার ফলে পাতার মাঝে একটা সরু অঞ্চল তৈরি হয়। ক্রমশ সব পাতার গোড়াতে এই বিশেষ অঞ্চল তৈরি হয়। একটা সময় সব পাতা হারিয়ে শূন্য ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মৃতপ্রায় গাছটি।
পাতায় সবুজ রঞ্জক পদার্থ ক্লোরোফিল থাকে। যা সালোকসংশ্লেষণে সাহায্য করে( 6CO2 + 12H2O + তাপ = C6H12O6 + 6H2O + 6O2 )। মানুষ যেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে। গাছেরও তেমন শ্বাস-প্রশ্বাসের প্রয়োজন হয়, যা নিয়ন্ত্রিত হয় পাতার মাধ্যমে। গাছ তার মূলরোমের মাধ্যমে যতটুকু পানি উত্তোলন করে তার সবটুকু শারীরবৃত্তীয় কাজে ব্যবহৃত হয় না। গাছ তার অতিরিক্ত পানি পাতার মাধ্যমে বাষ্পাকারে ছেড়ে দেয়।
শীতকালেও পাতার এই বাষ্পীয়করণ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কিন্তু শীতের এই শুষ্ক মৌসুমে গাছ খুব বেশি পানি উত্তোলন করতে পারে না। অপরদিকে গাছে যত বেশি পাতা থাকবে তত বেশি পানি হারিয়ে যাবে। ফলে পানি ঘাটতি দেখার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে শীতকালে উদ্ভিদে কীটপতঙ্গের আক্রমণ বেড়ে যায় এ আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে পাতা ঝরে। পাতা ঝরানোর ফলে ক্যাভিটেশন কমে যায় যা উদ্ভিদের জাইলেম ভেসেলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। এসব কারণে আত্মরক্ষার্থে গাছ শীতকালে পাতা ঝরিয়ে ফেলে।
আফিয়া ইমরাদ তাহাসিন
বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট
ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি চিটাগং
তথ্যসূত্র –