সমুদ্রের অপার বিশালতায় মুগ্ধ হন না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল। ‘আমাদের পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল’- এই কথাটি ছোটবেলা থেকে শুনে আমরা সকলেই বড় হয়েছি। পুরো পৃথিবীর ৭০% লবণাক্ত পানি দ্বারা বেষ্টিত থাকার কারণে আমাদের পৃথিবীটাকে নীল মুক্তার মতো আকর্ষণীয় মনে হয়৷ তবে সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যেন একেবারেই নগণ্য। গবেষকদের মতে, আমরা মঙ্গল গ্রহ সম্পর্কে যতটা জানি, তার চেয়েও অনেক কম জানি আমাদের সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে। অথচ এই পৃথিবীর সবকিছু একটি অপরটির সাথে জড়িয়ে রয়েছে। এমনকি আমাদের জীবন, আমাদের বেঁচে থাকাও সমুদ্রের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে৷
অনেক বিজ্ঞানীর মতে, পৃথিবীর জীবনের উদ্ভাবন ঘটেছে সম্ভবত সাগর-মহাসাগরের গভীরতায়, পৃথিবীর পৃষ্ঠে নয়। জীবনের উদ্ভাবন নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও এটা সত্য যে পৃথিবীর সমস্ত জীবনের অর্ধেকের বেশির বাসস্থান এই সমুদ্রই। সমুদ্রের জীববৈচিত্র্য এতটা বিস্তৃত যে এর সম্পর্কে আমরা এখনো পুরোপুরি জেনে উঠতে পারিনি।
চলুন এবার জেনে নিই কেন আমরা মহাসাগর সম্পর্কে জানবো এবং কেন সাগর-মহাসাগর আমাদের জন্য প্রয়োজনীয়।
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন অক্সিজেন। আর এই অক্সিজেনের ৮০% ই সরবরাহ করে থাকে আমাদের মহাসাগরগুলো। বলা হয়ে থাকে যে, আমরা সমুদ্র থেকে যত দূরেই অবস্থান করিনা কেন, আমরা যদি ১০বার শ্বাস গ্রহণ করি, তার ৭টিতেই সমুদ্র থেকে আসা অক্সিজেন গ্রহণ করি৷
সমুদ্রে থাকা আণুবীক্ষণিক জীব (এতই ক্ষুদ্র যে খালি চোখে দেখা যায় না), ফাইটোপ্ল্যাংকটন, ঠিক যেন কাজ করে আমাদের পৃষ্ঠে থাকা গাছের মতই। এরা প্রতিনিয়ত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করছে। সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকছে ্মানুষসহ সব প্রাণী প্রজাতি। একটি বহুল প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে পৃথিবীর ফুসফুস অ্যামাজন যা কিনা আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ২০% অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। এটি সম্পূর্ণরূপে ভুল একটি ধারণা। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত শ্বাস-প্রশ্বাসের অক্সিজেন সমুদ্রতেই উদ্ভূত হয়েছিল এবং এখন পর্যন্ত সমুদ্রই অক্সিজেনের যোগানদাতা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, এমনকি ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি শোষণ করে নেয় সমুদ্র।
আমাদের প্রতিদিনের আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনেও সাগর-মহাসাগরের প্রভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে তাপের সৃষ্টি হয় তার ৮০% শোষণ করে নেয় সমুদ্র।
আমাদের প্রতিদিনের আবহাওয়া এবং জলবায়ু পরিবর্তনেও সাগর মহাসাগরের প্রভাব রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে তাপের সৃষ্টি হয় তার ৮০% শোষণ করে নেয় সমুদ্র। পৃথিবী সৃষ্টির সময়ে আমাদের কেবল একটা মহাসাগর-ই ছিল। পরবর্তীতে এটি বিভক্ত হয়ে ৫টি মহাসমুদ্রে রূপ নেয়। এই সকল সমুদ্রই একে অপরের সাথে সংযুক্ত। পৃথিবীর ৯২% জল তার মহাসাগরেই রয়েছে। এগুলিই জলীয় বাষ্পের প্রাথমিক উৎস যা অবশেষে বৃষ্টিপাত হিসাবে পৃথিবীপৃষ্ঠে আসে। সমুদ্রগুলি নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে উষ্ণ পানি নিরক্ষীয় মেরুগুলির দিকে এবং মেরুগুলির বরফ পানি নিরক্ষীয় অঞ্চলে সঞ্চালনযোগ্য একটি পরিসীমা হিসাবে কাজ করার মাধ্যমে গ্রহের তাপমাত্রা বজায় রাখে। শুধু তাই নয়। ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, জলভূমি এমনকি কোরাল যা সমুদ্রে সংঘটিত নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে, তাদের টিকিয়ে রেখেছে একমাত্র এই মহাসাগরগুলোই।
আমরা অনেকেই জানি বিভিন্ন ওষুধের উপাদান প্রকৃতি থেকেই নেয়া। পৃথিবীপৃষ্ঠে বিরাজমান বিভিন্ন গাছগাছালি থেকেই মূলত বিভিন্ন কঠিন অসুখের ওষুধ আবিস্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। তবে স্থলভাগকে আবিষ্কার করা আমাদের প্রায় শেষ। এখন গবেষকরা নানান রোগ নিরাময়ের উৎস খুঁজতে ছুটছেন জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ সমুদ্রের দিকে। আমরা জানি ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া প্রতিনিয়ত মিউটেশন ঘটাতে থাকে। ইতিমধ্যে কিছু ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধের বিরুদ্ধে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হতে শুরু করেছে। খুব বেশিদিন তাই এসব ওষুধের উপর ভরসা করে থাকার উপায় নেই৷ তাই ওষুধের জন্য নতুন উৎস খোঁজা এখন সময়ের দাবি। এজন্যই বিজ্ঞানীরা নানা ধরণের স্পঞ্জি, কোরাল, সী-উইড এবং আরো নানা সামুদ্রিক প্রাণীর উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন যা এসব প্রতিরক্ষা সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কাজ করতে সক্ষম হবে। আশার কথা এটাই যে মরণব্যাধি ক্যান্সারের প্রতিষেধক খুঁজতেও সামুদ্রিক উৎস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এছাড়াও প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন তেল, গ্যাস ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ আমাদের মহাসাগরগুলো যা অর্থনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সমুদ্রপথে মালামাল পরিবহন সবচেয়ে সাশ্রয়ী।
সমুদ্র আমাদের জন্য কতটা অপরিহার্য একটি প্রাকৃতিক দান তা হয়তো আমরা অনুভব করতে পারি না চার দেয়ালের মাঝে বসে। পৃথিবীর প্রতিটা জীবন একটি অপরটির উপর নির্ভরশীল। মহাসাগরে জীবনের যে বিচিত্রিতা দেখা যায় তা কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের টিকে থাকা হুমকির মুখে পড়বে। আমরা যদি একটু সচেতন হই তাহলে মহাসাগর নিজ শক্তিতেই আবার নতুনভাবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে, আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবে যা অদূরে আমাদের জন্য, আমাদের পৃথিবীর জন্যই মঙ্গলময় হবে।
তাই সমুদ্রকে বাঁচাতে হলে, নিজেদের বাঁচতে হলে আগে মহাসাগর সম্পর্কে জানতে হবে।
“Without a healthy ocean, we don’t have a healthy planet.’’
নোশিন তাবাসসুম হৃদিতা
অনার্স ৩য় বর্ষ
ওশানোগ্রাফি এন্ড হাইড্রোগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি.
তথ্যসূত্র:
১। Why should we care about the ocean?.
২। 7 Reasons why the ocean is SO important – Oceanpreneur
৩। Marine drugs for cancer: surfacing biotechnological innovations from the oceans – PMC.