আমাদের মৃত্যু বলতে আমরা কি বুঝি? বিজ্ঞানের মতে, আমাদের মস্তিষ্কের মৃত্যু হওয়া মাত্রই আমরা মৃত। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ না হলে ছয় মিনিটের মধ্যেই এর কোষগুলো নিস্তেজ হতে শুরু করে। ফলশ্রুতিতে আমাদের সেন্ট্রাল নিউরোলজিকাল ফাংশন বা কেন্দ্রীয় স্নায়বিক কার্যক্রমের যে ক্ষতি সাধন হয়, তা আর নিরাময় করা সম্ভব হয় না। বয়সের সাথে সাথে বা এজিং এর কারণে দেহের অক্সিজেনের সরবরাহ দুর্বল হতে থাকে। একইভাবে, মস্তিষ্কেও রক্ত সরবরাহ বা অক্সিজেন সরবরাহ কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যায়। এধরনের মৃত্যুকে আমরা ‘সাধারণ মৃত্যু’ বা ‘নেচারাল ডেথ’ বলি।
যুক্ত্রাষ্ট্রের সান ডিয়েগোর ‘স্যাল্ক ইনস্টিটিউট’ এর অধ্যাপক হুয়ান কার্লোস ইজপিসিয়া বেলমন্ট একটি বিতর্কিত পরীক্ষামূলক কাজ করছেন, যা কিনা বার্ধক্যজনিত প্রক্রিয়াকে বিপরীতমুখী করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাৎ, ‘অ্যান্টি-এজিং এফেক্ট’ এর বাস্তবায়ন সম্ভব বলে তিনি দাবী করেন।
তাঁর গবেষণায় পরীক্ষামূলক ইঁদুরগুলোকে এমনভাবে রাখা হয় যাতে তাদের মধ্যে অকাল বার্ধক্য বা প্রি-ম্যাচিউর এজিং পরিলক্ষিত হয়। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগেই তাদের মধ্যে তাঁর ‘এলিক্সার’ প্রয়োগ করা হয়, যার ফলশ্রুতিতে ইঁদুরগুলোকে দেখে আগের চাইতে অনেক কম বয়সী মনে হয়। এমনকি, তাদের অধিকতর ঘন লোম, তুলনামূলক সুস্থ দেহ এবং অধিক কর্মক্ষমতাও পরিলক্ষিত হয়।
তবে বলে রাখা ভাল, বেলমন্টের এই প্রযুক্তিতে ইঁদুরের কোষের ডিএনএ থেকে মূল আণবিক ট্যাগ গুলো (Key molecular tag) সরিয়ে নেওয়া হয়। ‘এপিজেনেটিক রিপ্রোগ্রামিং’ নামে পরিচিত এই কৌশলটি হলো কোষগুলোকে পুনর্বাসন করে প্রাথমিক অবস্থায় নিয়ে যাওয়া অর্থাৎ ‘ফ্যাক্টরি সেটিংস’ এ ফিরে যাওয়ার মত; যা সম্পূর্ণ জীবের উপর করা হলে অবশ্যম্ভাবীভাবে বিশাল জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে। ফলে বেলমন্টের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অনেক ক্ষেত্রে, প্রথম দিকে ইঁদুরগুলো তাদের জীবনীশক্তি ফিরে পেলেও দ্রুত টিউমারের বিকাশ করে মারা গিয়েছিল। থেরাপির মাধ্যমে প্রদত্ত বার্ধক্য-বিরোধী প্রতিক্রিয়া বা অ্যান্টি-এজিং (Anti-aging) এফেক্টের সাথে টিউমার বিকাশের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া এখনও অনিশ্চিত।
বেলমন্টের কাজ বর্তমানে প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও তিনি একা নন। এমন আরও অনেক বিজ্ঞানী আছেন যারা বার্ধক্যকে কোষীয় আণবিক প্রক্রিয়া (Molecular process) হিসাবে দেখেন, যা কিনা শীঘ্রই সামঞ্জস্যপূর্ণ, থামানো বা বিপরীতমুখী করা যেতে পারে। জটিল কোষীয় রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার ক্রমাগত ব্যর্থতার ফলে আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে কোষ ও কলা বা টিস্যুগুলি জীর্ণ হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। অনেক গবেষণা দল দাবি করছে যে এই সমস্যাগুলোকে সমাধান বা রিসেট (Reset) করতে পারে এমন ‘জিনগত সুইচ’ (Genetic switch) পাওয়া গেছে।
এক্সেটার মেডিকেল স্কুলের মলিকুলার জেনেটিক্সের অধ্যাপক ডঃ লর্না হ্যারিস বলেছেন, “আমার মতে কোষীয় বার্ধক্যের কারণ হলো সারাজীবন জুড়ে কোষের উপর ধকল বা ‘সেলুলার স্ট্রেস’। এমন কিছু ‘মাস্টার কন্ট্রোল পয়েন্টস’ রয়েছে যেগুলোকে টারগেট করলে আণবিক চাপের প্রতিক্রিয়া (Molecular stress response) নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।”
হ্যারিস ও তাঁর দল সম্প্রতি দুটি মাইটোকন্ড্রিয়াল জিন খুঁজে পেয়েছেন যা নিষ্ক্রিয় করলে গবেষণাগারে কালচারকৃত মানব কোষগুলোতে (Cultured human cells) ‘অ্যান্টি-এজিং’ এফেক্ট প্রকাশ পায়। তিনি জানান, “সুতরাং এক অর্থে, এটি একটি ‘সুইচ’ হিসাবে দেখা যেতে পারে, তবে সেই সুইচটি অন-অফ করার পরিণতি অত্যন্ত জটিল এবং আমরা এখনও সেগুলোকে মানবদেহের উপযুক্ত করে তুলতে কাজ করছি। কেননা, জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত কোন কাজই একদম সহজ নয়।”
এছাড়াও, চলতি বছরই ‘ইয়েল স্কুল অব মেডিসিন’ এর গবেষকরা মস্তিষ্কের সঞ্জীবন (Brain reanimation) সম্পর্কিত একটি তোলপাড় সৃষ্টি করেন। তাঁরা একটি প্রতিবেদন পেশ করেন, যা জানায় যে তাঁরা মৃত্যুর ৪ ঘণ্টা পরও ৩২টি শূকরের মস্তিষ্ক পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। হ্যাঁ, মস্তিষ্কের কোষগুলোতে জীবনের পুনর্সঞ্চার। গবেষকরা মৃত অঙ্গগুলোকে এমন একটি সিস্টেমে রাখেন যেখানে রক্তের বিকল্প হিসেবে ‘ব্রেইন-এক্স’ (BrainEx) এর সাথে ইনফিউজ করা হয়। ব্রেইন-এক্স কোষগুলোকে অক্সিজেন স্বল্পতার পরও পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে। এমনকি মস্তিষ্কের অভ্যন্তরীণ কাঠামো বজায়ে রাখতেও সহায়তা করে এবং শক্তি উৎপাদন ও বর্জ্য অপসারণের মত কার্যক্রম (brain cell function) রিবুট করে।
সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে ইলেক্ট্রিকাল এক্টিভিটির পুনর্বিস্তার। তবে এখনও সমন্বিত কোন সিন্যাপ্টিক সিগন্যাল পাওয়া না যাওয়ায় চেতনার কোন ইঙ্গিতও নেই।
তাঁদের এই প্রকল্পের প্রধান গবেষক ও নিউরোলজিস্ট, অধ্যাপক নেনাদ সেস্টান ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত তাঁর রিসার্চ পাব্লিকেশনে জানান, “আমরা মূলত দেখাতে চেয়েছি যে মৃত্যু ধাপে ধাপে সংঘটিত একটি প্রক্রিয়া, যার কোন কোন ধাপের বা তার সময়ের পরিবর্তন, সংরক্ষণ কিংবা রিভার্স করা সম্ভব।” তিনি প্রথম দিকে মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক ও স্নায়বিক রোগ (Neurological disease) বোঝার জন্যই প্রাণী-মস্তিষ্কের কোষগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু, এসব বৈজ্ঞানিক বিষয়াদি ও নৈতিকতার সমন্বয় তাঁকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, মস্তিষ্কের মৃত্যুর বিষয়ে বর্তমান নির্দেশিকাগুলোকে পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন এবং চেতনা তৈরির ক্ষুদ্রতম সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলার জন্য গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পর্কে নতুন কোন তথ্য প্রকাশ করা হয়নি তবে বলা হচ্ছে পরবর্তী ধাপগুলো সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। যদিও শূকরগুলোর মস্তিষ্ক কেবলমাত্র আংশিকভাবেই পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল, তবুও আশা করা যাচ্ছে যে সেস্টান ও তাঁর দল এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বার্ধক্য-বিপরীতমুখীতা বা মৃত্যু থেকে ফিরে আসার ধারনাটি বাস্তবতার মুখ দেখুক বা না দেখুক, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে প্রথম দিকে সারা বিশ্বের উপর এর প্রভাব হবে বিশদ এবং ভয়াবহ।
তবে, এই ক্ষেত্রে কর্মরত বেশিরভাগ গবেষকের লক্ষ্য খুবই সহজ; চিরকাল যৌবন ধরে রাখা বা অমরত্ব লাভ নয়, বরং বয়সের সাথে মানুষকে দীর্ঘকাল ধরে সুস্থ রাখা।
– দারিমি হাসিন
শিক্ষার্থী, জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
তথ্যসূত্রঃ
- https://pubmed.ncbi.nlm.nih.gov/32020082/?from_single_result=32020082%5BPMID%5D
- https://www.salk.edu/news-release/putting-the-brakes-on-aging/
- https://www.sciencefocus.com/the-human-body/wild-ideas-in-science-theres-an-off-switch-for-ageing/
- https://www.sciencefocus.com/nature/death-redefined-how-pig-brain-function-was-restored-after-slaughter/