সম্প্রতি পৃথিবীর বেশ কিছু জায়গায় এমপক্স ছড়িয়ে পড়েছে। যার কারণে অনেকগুলো দেশ তাদের বন্দর গুলোতে রেড এলার্ট জারি করেছে। যাতে করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী তাদের দেশে প্রবেশ করতে না পারে। বাংলাদেশ ও এর ব্যতিক্রম নয়।
এমপক্স কী?
এমপক্স (M-Pox) একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এটি গুটিবসন্ত ও কাউপক্স ভাইরাসের একই পরিবারের অন্তভুক্ত। এই এমপক্স (M-Pox) এর পূর্ণ রূপ হলো মাঙ্কিপক্স (Monkeypox)। এটি পূর্বে মাঙ্কিপক্স নামেই পরিচিত ছিল।
এই রোগের লক্ষণগুলো কি কি?
এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো:
- জ্বর
- মাথাব্যথা
- পিঠে এবং পেশিতে ব্যথা
- গলা ব্যথা
- ফুসকুড়ি উঠা
- চুলকানো বা ব্যথা অনুভব হওয়া
- গ্রন্থি ফুলে যাওয়া ইত্যাদি
চিত্র ১: এমপক্স ভাইরাসের লক্ষণগুলো (Source: BBC, WHO)
রোগীর একবার জ্বর উঠলে গায়ে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। সাধারণত মুখ থেকে শুরু হয়ে পরে হাতের তালু এবং পায়ের পাতাসহ শরীরের অন্যান্য অংশে তা ছড়িয়ে পড়ে। যেসব স্থানে ফুসকুড়ি হয়েছে সেসব স্থানে অত্যন্ত চুলকানো বা ব্যথা অনুভব হয়। সময়ের সাথে সাথে এই ফুসকুড়িগুলো আকারে পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন ধাপ পার করে গোল গোল পুরু আস্তরে পরিণত হয়ে শেষে নিজ থেকে আপনা আপনিই পড়ে যায়। এর ফলে ক্ষত দাগের সৃষ্টি হতে পারে। এটি সংক্রমণের ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে এটি নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যেতে পারে। এই ভাইরাসের আক্রমণের ফলে মুখ, চোখ এবং যৌনাঙ্গসহ পুরো শরীরে ক্ষত তৈরি হতে পারে।
এই রোগ কিভাবে সংক্রমিত হয়?
এমপক্স মূলত সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে সরাসরি সংস্পর্শের মাধ্যমে কিংবা সংক্রমিত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সম্পর্ক, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি এসে কথা বলা বা শ্বাস নেয়ার মতো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে এটি একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ভাইরাসটি ফাটা চামড়া, শ্বাসতন্ত্র বা চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারে। এমনপক্সে আক্রান্ত রোগীর বা ভাইরাসে দূষিত হয়েছে এমন জিনিস যেমন বিছানা, পোশাক এবং তোয়ালে স্পর্শের মাধ্যমেও এটি ছড়াতে পারে।
বানর, ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো কোনো প্রাণী যদি এতে সংক্রমিত হয় আর কেউ যদি ওই সংক্রমিত প্রাণীর সঙ্গে বেশি কাছাকাছি আসে তবে তিনি এতে আক্রান্ত হতে পারেন।
এমপক্স প্রতিরোধের জন্য কি কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে না যেমনটা কোভিড-১৯ এর সময় আমরা নিয়েছিলাম? এই রকম প্রশ্ন আপনার মাথায় আসতেই পারে। তবে উওর হবে – হ্যাঁ । আমরা এমপক্স প্রতিরোধের জন্য বেশ কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। যেমন:
- নিয়মিত হাত ধোয়া
- মাস্ক পরা
- গ্লাভস ব্যবহার করা
- আক্রান্ত ব্যক্তিকে স্পর্শ না করা
- আক্রান্ত ব্যক্তির জিনিসপত্র ব্যবহার না করা
- আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্ঠ শারীরিক সংস্পর্শ এড়ানো
- আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে তার সাথে কথাবার্তা বলা
এই ভাইরাসের ইতিহাস কি?
এমপক্স ভাইরাস এর ইতিহাস জানতে আমাদের খুব বেশি পিছনে যেতে হবে না। এটি প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কে। সেখানকার গবেষণাগারে গবেষণার জন্য রাখা দুটি বানরের মধ্যে এই রোগ প্রথম দেখা যায় । এবং এই রোগের প্রথম মানব সংক্রমণটি ১৯৭০ সালে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে একটি ৯ মাস বয়সী শিশুর মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছিল।
এতো গুলো দিনে কোন কোন দেশে এই এমপক্স ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে?
আপনার এই প্রশ্নের উত্তর হবে – গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের মতো পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার গ্রীষ্মমন্ডলীয় রেইনফরেস্ট সমৃদ্ধ দেশের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হয় আর শত শত মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় ১৫ বছরের কম বয়সী শিশুরা। এই ভাইরাস মূলত ঐ অঞ্চলগুলোতে পাওয়া যায়, যেখানে এটি বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে । ১৯৭০ সালের পর থেকে, এই রোগটি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মাঝে মাঝে অন্যান্য মহাদেশেও প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে । আন্তর্জাতিক উদ্বেগ থেকে আফ্রিকার কিছু অংশে এমপক্সের প্রাদুর্ভাবকে জরুরি জনস্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(WHO)।
চিত্র ২: নয়টি দেশে গত মাসে এমপক্স শনাক্ত হয়েছে (Source: Türkiye Today)
২০২২-২০২৩ সালে, এমপক্সের একটি বৈশ্বিক প্রাদুর্ভাব ঘটে, যা আফ্রিকার বাইরে প্রথমবারের মতো ব্যাপক সম্প্রদায়িক সংক্রমণের ঘটনা ছিল। জুলাই ২০২২ সালে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এই প্রাদুর্ভাবকে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। বর্তমানে অনেকগুলো দেশে বিভিন্ন প্রাদুর্ভাব একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে- বিশেষ করে কঙ্গো এবং এর প্রতিবেশী দেশগুলোতে। রোগটি সম্প্রতি বুরুন্ডি, রুয়ান্ডা, উগান্ডা এবং কেনিয়াতে দেখা গেছে যা সাধারণত সেখানে দেখা যায় না।
এই ভাইরাসের ভিন্ন ধরনের দুটি ক্লেড রয়েছে: ক্লেড I এবং ক্লেড II। ক্লেড I প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার ১০% পর্যন্ত দেখা গেছে, যদিও সাম্প্রতিক ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার কম। ক্লেড II এর মৃত্যুর হার ০.২% এর কম। শিশু, গর্ভবতী নারী এবং দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা গুরুতর সংক্রমণের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ক্লেড I এর কিছু ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হবার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ২০২৩ সালেও সংক্রামিত অনেকের তুলনামূলকভাবে নতুন ও আরও গুরুতর ধরনের এমপক্স ক্লেড IB হওয়ায় এটি নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।
চিত্র ৩: আফ্রিকায় নতুন মৃত্যু সাপ্তাহিক ডেটা এবং দুই সপ্তাহের গড় (১৬ আগস্ট ২০২৪ পর্যন্ত) (Source: EL PAiS)
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্লেড IB সম্পর্কে অনেক কিছু জানা বাকি। তবে ধারণা করা হচ্ছে এটি সম্ভবত আগের ধরনের চেয়ে আরও সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, একইসঙ্গে আরও গুরুতর রোগের কারণ হতে পারে।আফ্রিকা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (CDC) বলছে ২০২৪ সালের শুরু থেকে জুলাইয়ের শেষ পর্যন্ত ১৫,৬০০ এর বেশি মানুষ এমপক্সে আক্রান্ত হয়েছে আর এতে ৫৩৭ জনের ও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যা ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় সংক্রমণের ক্ষেত্রে ১৬% এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে ১৯% বেশি। এর আগে ২০২২ সালে এমপক্সের মৃদু ধরন ক্লেড II এর কারণে জরুরি জনস্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল।
সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন রোগের উপসর্গযুক্ত ব্যক্তির স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবারের সদস্যসহ তার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা যে কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন। এদের মধ্যে অল্পবয়সী শিশুরা থাকতে পারে।কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ছোট শিশুরা যেভাবে একসাথে হয়ে খেলাধুলা করে এবং একে অপরের সঙ্গে মেশে তার কারণে তারা ঝুঁকিতে থাকতে পারে। ফলে রোগের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করা বেশি কঠিন হয়ে যায়। এছাড়াও তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল।দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার যে কারোরই, বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হবার আরও বেশি ঝুঁকি রয়েছে।
এর চিকিৎসা কি?
যদিও বর্তমানে এমপক্সের জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই, কিছু অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ পরীক্ষা করা হচ্ছে। এমপএক্সের টিকা আছে, তবে যারা ঝুঁকিতে আছে বা সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকছে কেবল তারাই এটি পেতে পারে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, যাদের প্রয়োজন তাদের সবার কাছে টিকা পৌঁছাবার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নেই। একমাত্র এই ভ্যাকসিনটি পশ্চিমা দেশগুলিতে মজুদ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়। এমনকি আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত না হলেও জরুরি ব্যবহারের জন্য এমপক্সের টিকাগুলো দেয়ার জন্য সম্প্রতি ওষুধ প্রস্তুতকারকদের নির্দেশ দিয়েছে WHO ।
আর এখন যেহেতু আফ্রিকার CDC মহাদেশব্যাপী “জরুরি জনস্বাস্থ্য অবস্থা” ঘোষণা করেছে, আশা করা যায় এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারগুলো আরও ভালভাবে সমন্বয় করতে সক্ষম হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় চিকিৎসা সরবরাহ এবং সহায়তার প্রবাহকে সম্ভাব্য পরিমাণে বাড়াবে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পাকিস্তান কিছু এমপক্স এর রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো কোনো এমপক্স এর রোগী শনাক্ত হয়নি, তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উচ্চ সতর্কতা জারি করেছে।
নাম: নাবিলা রব।
ইনস্টিটিউট: ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি।
তথ্যসূত্র:
- Islam, Md. J. (n.d.). Assessing preparedness for Mpox. In Dhaka Tribune. Retrieved August 26, 2024, from https://www.dhakatribune.com/opinion/op-ed/355235/assessing-preparedness-for-mpox
- Mpox (Monkeypox) outbreak toolbox. (n.d.). World Health Organization. Retrieved August 26, 2024, from https://www.who.int/emergencies/outbreak-toolkit/disease-outbreak-toolboxes/mpox-outbreak-toolbox
- Mpox: A growing concern, but not a pandemic – Health experts. (n.d.). Sinar Daily. https://www.msn.com/en-my/health/other/mpox-a-growing-concern-but-not-a-pandemic-health-experts/ar-AA1pd7ai?ocid=BingNewsVerp
- Gallaghe, J. (n.d.). How worried should we be about mpox? BBC. https://www.msn.com/en-us/health/other/how-worried-should-we-be-about-mpox/ar-AA1pd6XF?ocid=BingNewsVerp
Leave feedback about this